ক্লাসরুমে 'দুরাত্মা'
★★★★★★★
পঞ্চম পিরিয়ড চলছে। ক্লাস সিক্সের বাংলা ব্যাকরণের ক্লাস নিচ্ছি। বিষয় বিসর্গ-সন্ধি। আজ আমার ভূতের গল্প বলার দিন। সেই মতোই কথা ছিল। গতদিন ক্লাসে দেবার্পণ, ময়ঙ্ক, ধৃতিমানেরা ভূতের গল্প শোনার বায়না ধরে। একেবারে নাছোড়বান্দা। শেষে কথা দিয়েছিলাম যে অবশ্যই পরের দিন একটা ভূতের গল্প বলবো।
তাই আজ ক্লাসে ঢুকে বাংলা ব্যাকরণটা একটু শুরু করতেই শুরু হয়ে গেল গুঞ্জন। হঠাৎ তৃতীয় বেঞ্চের রজতশুভ্র উঠে বলল,
"স্যার্ গল্পটা ? মনে আছে তো ? আমরা কিন্তু ভুলিনি।" কথাটা শেষ হতে-না হতেই দেবার্পণ বেঞ্চ থেকে তড়াক করে উঠে দাঁড়াল ও এগিয়ে এসে ক্লাসরুমের দরজাটা বন্ধ করে দিতে চাইল। পেছনের বেঞ্চের অভিমন্যু আবার মাঠের দিকের জানালার ছিটকিনি লাগানোয় ব্যস্ত হয়ে উঠল। উদ্দেশ্য, ভৌতিক আবহ সৃষ্টি করা। দু'জনকেই বারণ করলাম মৃদুভাবে।
দুয়েকজন বলে উঠল, "স্যার, আজ স্কন্ধকাটা ভূতের গল্প শুনবো।
কেউ বলল,"না স্যার, একপেয়ে ভূতের গল্প শুনব। ওরা তালগাছে থাকে।"
ব্ল্যাকবোর্ডে চক দিয়ে সন্ধিগুলি লিখতে লিখতে বললাম, "অবশ্যই বলব তবে আগে পড়াশোনা; পরে শেষের দশমিনিট হবে ভূতের গল্প।" একবাক্যে সকলের সম্মতি পেলাম।
ভাবলাম পড়া ছেড়ে গল্প বলাটা ঠিক নয়। গল্প করার আলাদা সময় আছে। তাছাড়া স্কুলের ইউনিট টেস্টও আসন্ন। এদিকে আবার গতকাল প্রমিস করেছি , শুধু শুধু শিশুমনে আঘাত দেওয়াও তো কাম্য নয়।
আমি অবশ্য হেমেন্দ্র কুমার রায়ের একটা রোমহর্ষক ভূতের গল্প মনে মনে ভেবেও রেখেছিলাম।
ব্যাকরণ বিষয়টাই বড্ড বোরিং। কচিকাঁচাদের কোমল মস্তিষ্কে অত্যাচার ছাড়া আর কিচ্ছু নয়। এমন অবস্থায় শ্রেণিকক্ষে মনোযোগ ফিরিয়ে আনতে শিক্ষককে কতো কিছুই-না করতে হয়। যেমন ক্যুইজ, ধাঁধা, ভূতের গল্প ইত্যাদি ইত্যাদি। ফলও পাওয়া যায় হাতে-নাতে। বিশেষ করে টিফিনের পর। এই যেমন আজ, সারা ক্লাস মনোযোগী হয়ে উঠেছে। সকলের মনে বেশ একটা চনমনে ভাব। কারণ আজ তারা ভূতের গল্প শুনবে।
সবকিছু ঠিকঠাক চলছিল। ব্ল্যাকবোর্ডে এক-এক করে সন্ধিগুলি লিখে দিচ্ছি। এই যেমন পুনর্জাগরণ, শিরশ্ছেদ, দুর্ধর্ষ , দুরাত্মা .....
কিন্তু একি!! "দুরাত্মা" কথাটি লিখে শেষ করতেই একি হলো ? চকটির উপর আমি ক্রমে নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছি।
আমার হাত থেকে চকের খণ্ডটি এক অজানা কারণে ব্ল্যাকবোর্ডের গায়ে আকৃষ্ট হতে চাইল। পর মুহূর্তেই আমার হাতে আর সেই চকটি নেই। চক সেই বোর্ড থেকে নড়ছে না। এ কোন আকর্ষণ !!
এমনটা তো হওয়ার কথা নয়। কোথায় গেল নিউটনের নিয়ম!! কেনই-বা "দুরাত্মা" লিখতে গিয়েই এমনটা হবে ? সেই অশুভ শব্দটি যেন আমার দিকে তাকিয়ে বিশ্রীভাবে অট্টহাস্য করছে। ব্ল্যাকবোর্ড দৈত্য যেন কালো বীভৎস গ্রাসে চকটিকে হজম করতে চাইছে।
ভাল করে বোর্ডে লক্ষ্য করলাম এবং
শব্দগুলি পরপর যোগ করে আঁতকে উঠলাম। এইসব কী লিখেছি আমি!
দুর্ধর্ষ - দুরাত্মা - পুনর্জাগরণ - শিরশ্ছেদ ইত্যাদি !!
সত্যি কী অলক্ষুণে শব্দগুলি !!
একটা ঠাণ্ডা হাওয়ার স্রোত শিরদাঁড়া দিয়ে নেমে গেল। দূরের বেলগাছটায় থেকে একটা কাক কর্কশভাবে ডেকে উঠল।
এইসবের উত্তর আমার বোধগম্যতার বাইরে। দীর্ঘ নয় বছরের চাকরি-জীবনে এমন অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হইনি কোনোদিন। দুনিয়ার কোনো শিক্ষকের জীবনে এমনটা ঘটেছে বলেও মনে হয়না।
ঘটনার আকস্মিকতায় কিছুটা হতচকিত হয়ে পড়লাম। মাথার উপর বনবন করে ফ্যান ঘুরতে থাকলেও কপালে ঘর্মবিন্দু দানা বাঁধতে লাগল। বুঝলাম এই ঘাম যেমন-তেমন ঘাম নয়। তার মানে সত্যিই কি আমি ভয় পেয়েছি !!
এক ঝটকায় আচমকা দু'হাত পিছিয়ে এলাম।
হঠাৎ কেঁপে উঠলাম সামনের বেঞ্চে বসে থাকা ধৃতিমানের গলা শুনে। সে বলল, " স্যার আমরা কিন্তু ম্যাজিক দেখতে চাইনি। আমরা ভূতের গল্প শুনতে চাই।"
কিন্তু কিসের ম্যাজিক? আমি তো জানি যে এটা ম্যাজিক নয়। তবে কি এটা কোনও স্বপ্ন ! চিমটি কেটে দেখব একবার ? নাঃ, এমন বোকামির কোনো মানে হয়না। নিজেই তো বুঝতে পারছি এটা স্বপ্ন নয়, সত্যি। কিন্তু যে কাণ্ডটা ঘটছে তা কি সত্যিই কোনো ভৌতিক ব্যাপার !! ক্লাসশুদ্ধ ছাত্রদের সামনে এইসব কী ভাবছি আমি !! কিন্তু নিজের চোখে যা দেখছি তা অস্বীকার করি কীভাবে !!
আমি চিরকাল যুক্তিবাদী ও কৌতূহলপ্রবণ। চক-ডাস্টার ঘষেই আমার সংসার চলে। সেই আমি কিনা একটা সামান্য চক দেখে ভয় পাচ্ছি! তাও আবার দিন-দুপুরে !
নাঃ, এর রহস্য উন্মোচন করতেই হবে। আর যাই হোক, আমি ভীতু - এটা রটে যাবে তা হতে পারে না।
ঘটনার পরে বেশ কিছুদিন কেটে গিয়েছে। একটা তুচ্ছ বিষয়কে নিয়ে এতো কিছু! নিজের বোকামির উপর মাঝে মাঝে যে হাসি পায় না, তা নয়।
ক্লাসের আগে রাত-জেগে ভূতের গল্প পড়ার হ্যাংওভারটা তো ছিলই। সেই সাথে সেদিন তাড়াহুড়ো করে চকের প্যাকেট খুলে চকখানা নিই। নতুন প্যাকেটের গায়ের চটচটে আঠা কী করে-যে চকের গায়ে লেগে গিয়েছিল, বুঝতেই পারিনি।
~~
Comments
Post a Comment